মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মোশা বাহিনীর টর্চার শেল, নির্মম নির্যাতন আতঙ্কে রূপগঞ্জের ৭০টি সংখ্যালঘু পরিবার

রূপগঞ্জের ত্রাস মোশাররফ হোসেন মোশা বাহিনীর আতঙ্কে নাওড়া এলাকার ৭০টি সংখ্যালঘু পরিবার আতঙ্কে ভুগছে। সেখানে গড়ে ওঠা মোশা বাহিনীর টর্চার সেলে সংখ্যালঘু পরিবারের লোকজনকে ধরে নিয়ে বর্বরোচিত কায়দায় নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতি রাতেই এসব সংখ্যালঘু পরিবারের গৃহবধূ ও সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে মোশার রংমহলে ফূর্তি করা হয়। নির্যাতনের শিকার অনেকেই চিকিৎসা নিতে এলাকার বাইরে যেতে পারছে না। মোশা বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা গোটা এলাকা অবরুদ্ধ করে রাখে। বর্তমানে অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছে। মোশা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা কেউ টুঁ-শব্দ করতে সাহস করেন না। যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে মোশা রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলছে। মোশা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে সংখ্যালঘু পরিবারের লোকজন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত এক দশক আগে নাওড়া এলাকায় প্রায় ১৫০ সংখ্যালঘু পরিবার বসবাস করত। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখানকার সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ওপরে নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। ওই সময় থেকেই মোশা বাহিনীর প্রধান মোশাররফ হোসেন মোশা, বদিউজ্জামান বদির লোলুপ দৃষ্টি পড়ে সংখ্যালঘু পরিবারের জমি ও সুন্দরী মেয়েদের ওপর। এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের ওপর নির্যাতন। যারা জমি আর ঘরের সুন্দরী নারী দিতে অস্বীকৃতি জানাতো তাদেরই মোশার টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করত। গত পাঁচ বছরে মোশা বাহিনীর নির্যাতন আর অত্যাচার সইতে না পেরে ৮০টির মতো পরিবার ভারতসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। বর্তমানে যারা বসবাস করছে তারা পৈতৃক ভিটে রক্ষায় মাটি আঁকড়ে কোনো মতে বেঁচে আছেন।

মোশার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সংখ্যালঘু পরিবারের কেউ জমি কিংবা চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে রাতে অস্ত্রের মুখে তুলে নেওয়া হয় টর্চার সেলে। পরে রশি দিয়ে বেঁধে বিবস্ত্র করে বর্বরোচিত কায়দায় নির্যাতন করা হয়। সম্প্রতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আশাপূর্ণ দাস তার জমি বিক্রি থেকে মোশার দাবিকৃত চাঁদা না দেওয়ায় তার ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। তাকে টর্চার সেলে ধরে নিয়ে হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে শরীরে লবণ ও মরিচের গুঁড়া মেখে বেধড়ক পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়। তাকে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাওড়া এলাকার একজন সংখ্যালঘু গৃহবধূ বলেন, 'একদিন আমারে দেইখ্যা মোশার খারাপ নজর পড়ে। পরে আমারে কুপ্রস্তাব দেয়। রাজি না অওনে রাইত কইরা হের লোকজন অস্ত্র দেহাইয়া আমার সোয়ামীর সামনে থেইক্যা ধইরা নিয়া যায়। সারারাইত নির্যাতন কইরা ছাইড়া দেয়। জীবনের ভয়ে মামলাও করবার পারি নাই। ভগবান ওর বিচার করবো।' গত কয়েক দিন আগে এক কর্মকার পরিবারের ১৬ বছরের যুবতী মেয়েকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যায় মোশা বাহিনী। পরে হাত রশি দিয়ে বেঁধে মোশা ও বদি রাতভর পাশবিক নির্যাতন করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই যুবতী জানায়, তাকে রাতে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে মোশার রংমহলে বিবস্ত্র করে হাত রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। পরে মোশা ও বদি মিলে নির্যাতন করে। এ সময় হুমকি দিয়ে বলে, মুখ খুললে জীবনে মেরে ফেলবে। সূত্রটি আরও জানায়, নিজেদের রংমহল ছাড়াও মোশা ও বদি ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে ফূর্তি করে। গত দুই মাস আগে ঢাকার এক আবাসিক হোটেলে নারী নিয়ে ফূর্তি করার সময় বদিউজ্জামান বদিকে পুলিশ হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরে ৪০ হাজার টাকায় রফাদফা শেষে নিজেকে কোনো মতে রক্ষা করে বদি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংখ্যালঘু পরিবারের কয়েকজন বলেন, আমরা ভোট দেই শেখের বেটিরে। নৌকা মার্কা আমাগো জান-পরাণ। শেখের বেটি আমাগো জীবন। এটাই কি আমাদের অপরাধ?

সরেজমিন এলাকা ঘুরে জানা যায়, মোশা বাহিনীর ভয়ে সংখ্যালঘু পরিবারগুলো ঠিকমতো কাজে যেতে পারছে না। এসব পরিবারের কেউ কামার, কেউ দিনমজুর, কেউ মুড়ি বিক্রেতা আবার কেউবা কৃষক। এদের অনেকেই এখন খেয়ে না খেয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছে। স্থানীয়রা জানান, যেসব পরিবার মোশার নামে জমি লিখে দিতে না চায় তাদেরই কাজে যেতে দেওয়া হয় না। মোশাররফ বাহিনী গোটা এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। অপরিচিত কেউ এলাকায় ঢুকতে পারে না। আর যারা এলাকায় বসবাস করছে তারাও এলাকার বাইরে যেতে পারছে না। এলাকাবাসী বলেন, নাওড়া এলাকাটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। গ্রামটির দক্ষিণে খাল। পশ্চিমে বালু নদী। উত্তরে-পূর্বে দীর্ঘ ফাঁকা জায়গা। দুর্গম এ এলাকায় পুলিশ কিংবা র‌্যাবের যেতে লাগে দীর্ঘ সময়। ফলে মোশা ও তার বাহিনী অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে। প্রশাসনের লোকজন এলাকায় পৌঁছতে-পৌঁছতে মোশা বাহিনী ঘটনা ঘটিয়ে আত্দগোপনে চলে যায়। প্রশাসনের লোকজন চলে আসলে তারা আবার এলাকায় দাবড়ে বেড়ায়। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রূপগঞ্জের মিনি গডফাদারখ্যাত মোশার সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের রয়েছে কানেকশন। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান আসামি ও মিনি গডফাদার নূর হোসেন, সুব্রত বাইনসহ অনেক কিলারের সঙ্গে মোশার ছিল সম্পর্ক। মোশার রয়েছে অস্ত্রের ভাণ্ডার। রয়েছে মাদকের গোডাউন। মোশা নিজেকে কোনো সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছের লোক, কোনো সময় ডিআইজির আত্দীয়, কোনো সময় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার আত্দীয় আবার কোনো সময় দুই-তিনজন এমপির ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে সংখ্যালঘু পরিবারের লোকজন বর্তমানে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পাশাপাশি মোশা বাহিনীর আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। মোশা বাহিনীর নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে বাঁচাতে সংখ্যালঘু পরিবারগুলো প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।


- See more at: http://www.bd-pratidin.com/2014/06/21/12993#sthash.QCPfw5Zw.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন