
গীতা কবেকার ? এটা দ্বারা তিনি গীতার অর্বাচীনত্ব বা কম সময়ের না প্রাচীনত্ব, কোনটাকে ইঙ্গিত করেছেন, সেটাই তো পরিষ্কার হচ্ছে না। তিনি সম্ভবত, গীতা তো এই সেদিনের বই, এরকম কিছু একটা বলতে চেয়েছেন। তাহলে দেখা যাক গীতার আসলে বয়স কত।
গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১ নং শ্লোকে বলা আছে,
“ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম।।
বিবস্বান্মনবে প্রাহ মনুরিক্ষবাকবেহব্রবীৎ।।”
এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আমি এই জ্ঞান কল্পের আরম্ভে সূর্যদেব বিবস্বানকে বলেছিলাম। সূর্য তা মানবজাতির জনক মনুকে বলেছিলেন এবং মনু ইক্ষবাকুকে বলেছিলো।
এরপর ২ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছেন তার বাংলা হলো-
এই ভাবে পরম্পরার মাধ্যমে এই পরম বিজ্ঞান রাজর্ষিগণ এই জ্ঞান লাভ করেছিলেন। কিন্তু কালের প্রবাহে পরম্পরা ছিন্ন হয়েছিলো এবং এই সেই জ্ঞান নষ্ট প্রায় হয়েছে।
এরপর ৩ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
সেই সনাতন যোগ আজ আমি তোমাকে বললাম।
১ নং শ্লোকের ব্যাখ্যায় কল্পের আরম্ভে ব’লে একটা কথা আছে। হিন্দু কাল গণনায় কল্পের আরম্ভ মানে হলো বিশ্ব সৃষ্টির শুরু। এর থেকে প্রমান হচ্ছে যে, গীতার জ্ঞান বিশ্ব সৃষ্টির শুরু থেকেই আছে। কিন্তু মাঝখানে এই জ্ঞান কিছুটা নষ্ট হয়ে এর বিশুদ্ধতা হারিয়ে ফেলে এবং এ কারণেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এই জ্ঞান আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দেন। সুতরাং গীতার জ্ঞান যে বিশ্বের শুরু থেকেই আছে, সেটা কিন্তু এখানে স্পষ্ট। এ তো গেলো গীতা সম্পর্কে গীতার নিজের সাক্ষ্য। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাস এ ব্যাপারে কী বলছে দেখুন-
“বর্তমানে এটিকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণরচিত প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত-এর একটি অংশ হিসেবে পাওয়া গেলেও মহাভারতের পূর্ব থেকেই গীতা একটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থ তথা একটি পৃথক উপনিষদ হিসেবে অস্তিত্বশীল ছিলো ।“
মহাভারতের পূর্বে এই গীতার নাম ছিলো গীতোপনিষদ, তো মহাভারতের পূর্বে তো কৃষ্ণই ছিলো না, তাহলে গীতা এলো কোথা থেকে। এখন গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১ নং শ্লোকের কথা স্মরণ করুন যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছে, এই জ্ঞান সৃষ্টির শুরুতেই আমি সূর্যদেবকে দিয়েছিলাম, মাঝখানে পরম্পরা হারিয়ে এটা নষ্ট প্রায় হয়েছে। এই নষ্ট প্রায় গীতা ই ছিলো গীতোপনিষদ। কিন্তু ব্যাসদেব মহাভারত রচনাকালে যখন নতুন করে গীতার বাণী তার মধ্যে সংযোজন করতে পারেন, তখন সেই পুরোনো গীতোপনিষদের আর প্রয়োজন না থাকায় এমনি ই তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
গীতা সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা আছে, এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৫০০ অব্দের মধ্যে রচনা। এই হিসেবে গীতার বয়য়স দাঁড়ায় ২৪০০/২৫০০ বছর, কিন্তু এটা গীতার জ্ঞান লিখিত রূপ পাওয়ার বয়স। হিন্দু ধর্মের সব প্রাচীন গ্রন্থের মতো গীতাও গুরু শিষ্য পরম্পরায় হাজার হাজার বছর পূর্ব থেকে শ্রুত হয়ে আসছে। এ কারণে গীতার প্রাচীন দুটো নাম হলো শ্রুতকাব্য ও স্মৃতিকাব্য। শ্রুত বলতে বোঝায় শুনে শুনে মুখস্থ করা আর স্মৃতি বলতে বোঝায় মুখস্থ থেকে স্মরণ করে বলা। সুতরাং উইকিপিডিয়ায় গীতার বয়স ২৪০০/২৫০০ বছর দেখে এটা ভাববেন না যে গীতা ঐ সময়ে কেউ লিখে বই আকারে ছাপিয়ে প্রকাশ করেছিলো, যেমন ভেবে বসে আছে আমাদের এই ডক্টরেট পণ্ডিত। কারণ “গীতা কবেকার ?” বলতে তিনি এই বিষয়টিকেই ইঙ্গিত করেছেন। সম্ভবত কোরান শরীফের চেয়ে গীতার বয়স কম হলে তিনি আরো খুশি হতেন।
গীতা সম্পর্কে সে আরও খোঁচা দিয়ে আমাকে বলেছে, “গীতাটা -- মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত অংশ , এটা জানো তো ?”
খেয়াল করবেন, তিনি বলেছেন, “গীতাটা -- মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত অংশ”- এর মানেহচ্ছে মহাভারত থেকে গীতাকে প্রক্ষেপ বা নিক্ষেপ বা ছুঁড়ে মারা হয়েছে, এক কথায় সংকলন করে নতুন বই বানানো হয়েছে। ঠিক ই তো আছে, গীতা যে মহাভারতেরই একটা অংশ এবং সেই অংশকে “আদি শংকরাচার্য” নামের এক ক্ষণজন্মা ব্যক্তি আলাদা গ্রন্থ হিসেবে তৈরি এবং প্রচার করেন ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, এটা তো অনেকেই জানে। তিনি সম্ভবত বলতে চেয়েছেন, “গীতাটা- মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত”, কারণ হিন্দু বিদ্বেষী আনন্দবাজার মিডিয়া এমনটাই প্রচার করে থাকে। Nimaipada Biswas যদি এটাও বলতে চেয়ে থাকেন, “গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত”, মানে মহাভারতের মধ্যে গীতাকে কেউ পরে ঢুকিয়ে দিয়েছে; তাহলেও তো ঠিকই আছে, বেদব্যাস তো মহাভারতের মধ্যে গীতাকে ঢুকিয়েই দিয়েছেন বা প্রক্ষেপই করেছেন। তার খোঁচা তো দেখি আমার গায় কোনোভাবেই লাগাতে পারছি না। কিন্তু খোঁচা তো উনি দিয়েছেন, লেখার ভুলের কারণে হয়তো সেটা এখন আর আমার গায়ে লাগছে না। আসলে ডক্টরেট হলেই যে বাংলা শুদ্ধভাবে লেখা যায় না বা যা বলতে চায় সেটা যে ঠিক মতো বলতে পারে না, তার এই খোঁচার বাণীটি তার একটি প্রমাণ। আসলে তিনি বলতে চেয়েছেন, গীতা ঐ ২৪০০/২৫০০ বছর আগেই প্রথম লেখা হয় এবং তারপর কেউ তা মহাভারতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
এটা সত্য হলে গীতার সেই লেখকের নাম তার কাছে জানতে চাই, কে ঢোকালো তার নামও জানতে চাই, হিন্দু ধর্মের কয়েকশত গ্রন্থ থাকতে কেনোই বা শুধু গীতাকে মহাভারতের মধ্যে ঢোকানোর প্রয়োজন হলো সেই কারণও জানতে চাই, আর এটা ক’রে কার কী লাভ হয়েছে বা মূলত উদ্দেশ্য কী ছিলো সেটাও জানতে চাই। আমাদের ডক্টরেট সাহেবের থিসিসের বিষয়বস্তু ছিলো হিন্দু ধর্ম। সুতরাং হিন্দু ধর্মের প্রধান পুস্তক গীতা সম্পর্কে তার কাছে এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। ডক্টরেট সাহেব বলেছেন তার লেখার প্রতিটা শব্দ ধরে ধরে পড়তে, আপনার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি শুধু শব্দ নয় বর্ণ ধরে ধরে পড়ছি আর তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি। এই অনুচ্ছেদে আমার মূল ফোকাস ছিলো “গীতা মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত” না “গীতা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত”, খেয়াল করবেন দুটি বাক্যের পার্থক্য কিন্তু শুধু একটা ‘র’ তে।
জয় হিন্দ।
------------------------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন